১৩ অক্টোবর পালিত হয় বিশ্ব থ্রম্বোসিস দিবস।
গত ১৩ অক্টোবর পালিত হয় বিশ্ব থ্রম্বোসিস দিবস। সারা বিশ্বের মতো বাংলাদেশেও নানা আয়োজনে পালিত হয় দিবসটি। রক্ত জমাট বাঁধা বা থ্রম্বোসিসজনিত রোগগুলো সম্পর্কে সচেতনতা তৈরির উদ্দেশ্যেই এ দিবসটি পালন করা হয়ে থাকে। নর্থ ইষ্ট মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের হেমাটোলজি বহির্বিভাগে রোগীদের অংশগ্রহণে এক সচেতনতা মূলক আলোচনা করা আয়োজন করা হয়।জমাট বাঁধা রক্তের দলাকে বলা হয় থ্রম্বাস আর জমাট বাঁধার পদ্ধতিটির নাম থ্রম্বোসিস।
রোগের লক্ষণ:
বেশিক্ষণ পা ঝুলিয়ে বসে থাকলে অনেকের পা ফুলে যায়। এটা অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু যদি অল্প সময়ের মধ্যে পা ফোলে, সঙ্গে মৃদু যন্ত্রণা হয়, সেখানে ত্বক লালচে হয়ে যায়, এগুলোকে ডিপ ভেন থ্রম্বোসিসের লক্ষণ বলেই ধরে নেওয়া হয়। ডিভিটি-র অন্যতম লক্ষণ হল স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি পা ফোলা যা হঠাৎ করে অথবা ধীরে ধীরে হতে পারে। যে জায়গাটা ফুলছে, সেই জায়গায় আঙুল দিয়ে চাপ দিলে সেটা ঢেবে যাবে। তা ছাড়া, ফোলা অংশটা সামান্য গরমও হতে পারে।’
কেন হয় ডিভিটি?
ডিভিটি হওয়ার প্রধান কারণ, শিরায় রক্তপ্রবাহের বেগ কমে যাওয়া অথবা রক্তের স্বাভাবিক জমাট বাঁধার প্রক্রিয়ার সমস্যা। ষাট বা তার বেশি বয়সের ব্যক্তিদের মধ্যে এই রোগ হওয়ার সম্ভাবনা অপেক্ষাকৃত বেশি। যদিও কম বয়সের মানুষদেরও এই সমস্যা হতে পারে। যেমন, যাঁদের দীর্ঘক্ষণ পা ঝুলিয়ে বসে বা দাঁড়িয়ে কাজ করতে হয় বা যাঁরা অনেকক্ষণ একনাগাড়ে গাড়ি চালান, তাঁরাও ডিভিটি-তে আক্রান্ত হতে পারেন।
প্যারালিসিসের মতো শারীরিক অসুস্থতা বা অস্ত্রোপচারের কারণে যাঁদের বহু দিন বিছানায় শুয়ে থাকতে হয়, তাঁদের পায়ের শিরায় রক্তপ্রবাহের গতি কমে যাওয়ার ফলে হতে পারে এই রোগ।
কিন্তু থ্রম্বোসিস হলে বা রক্তনালীতে রক্ত জমাট বাঁধলে ক্ষতি কি?
রক্তনালীর কাজ হচ্ছে দেহের প্রতিটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে রক্ত পৌঁছে দেয়া। রক্ত চলাচল পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গেলে ঐ অঙ্গটি অকেজো হয়ে পড়ে অথবা মারা যায়। থ্রম্বোসিস রক্তনালীর মধ্যে দিয়ে রক্ত চলাচল বাধাগ্রস্ত করে।যদি হৃৎপিণ্ড বা হার্ট (Heart) অথবা মস্তিষ্ক বা ব্রেন (Brain)-র রক্তনালীতে থ্রম্বোসিস হয় তাহলে একজন ব্যক্তি কয়েক মিনিটের মধ্যে মারা যেতে পারেন। যদি তাৎক্ষণিক মারা না-ও যান, অথবা অন্য কোনো অঙ্গের রক্তনালীতে থ্রম্বোসিস হয়, তাহলে চিরকালের জন্য অসুস্থ হয়ে জীবন যাপন করতে হতে পারে। দেখা গেছে, সারা বিশ্বে মৃত্যুর চারভাগের একভাগ অর্থাৎ ২৫% ক্ষেত্রে থ্রম্বোসিস কোনো না কোনো ভাবে জড়িত।
থ্রম্বোসিস কাঁদের হয়?
থ্রম্বোসিস হওয়ার কারণ অনেক। এটা ধমনী বা আর্টারি (Artery)-তে হতে পারে, যে রক্তনালীগুলো কোনো অঙ্গে রক্ত পৌঁছে দেয়। আবার বড় আকারের শিরা বা ভেইন (Vein)-এ হতে পারে যেগুলো কোনো অঙ্গ থেকে রক্ত হৃৎপিণ্ডের ভেতরে বয়ে নিয়ে আসে। কখনও কখনও হৃৎপিণ্ডের কোনো অসুখের কারণে হৃৎপিণ্ডের ভেতরেও থ্রম্বোসিস হতে পারে। হৃৎপিণ্ডের ভেতরের থ্রম্বোসিস ভেঙে গিয়ে কোনো রক্তনালীকে (সাধারণত কোনো ছোট ধমনী) বন্ধ করে দিতে পারে। আবার, বড় কোনো শিরার ভেতরের জমাট রক্ত ভেঙে ছুটে গিয়ে ফুসফুসের ধমনীকে বন্ধ করে দিতে পারে।
হৃৎপিন্ড ও মস্তিষ্কে যে রক্তনালীগুলো রক্ত পৌঁছে দেয় সেগুলোতে থ্রম্বোসিস হওয়ার সম্ভাবনা বেশী থাকে যদিঃ
• অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস (Diabetes) বা উচ্চ রক্তচাপ (High blood pressure, Hypertension) থাকে।
• রক্তে অথবা দেহে চর্বির পরিমাণ বেশী থাকে।
• ধূমপান-মদ্যপানের অভ্যাস থাকে।
• পরিশ্রম বা ব্যায়াম করার অভ্যাস কম থাকে।
অন্যদিকে, বড় বড় শিরা রক্তনালী (Large Veins), যারা পা থেকে রক্ত হৃৎপিণ্ডের দিকে নিয়ে আসে, তাদের ভেতরে থ্রম্বোসিস হতে পারেঃ
• একটানা অনেকক্ষণ অথবা অনেকদিন পায়ে নড়াচড়া না হলে, যেমন, একটানা অনেকক্ষণ বসে থাকলে (যেটা প্লেনে অনেক দূরে গেলে) অথবা অনেকদিন অসুস্থ হয়ে বিছানায় পড়ে থাকলে
• পেটে বা পায়ে অপারেশন হলে
• কিছু কিছু ক্যান্সারে ও ক্যান্সারের চিকিৎসায়
• বার্ধক্য, অতিরিক্ত ওজন, পায়ের আঁকাবাঁকা শিরা, গর্ভাবস্থা ও হরমোন চিকিৎসায়।
বড় শিরাতে থ্রম্বোসিস হওয়ার একটা বিপদ হচ্ছে এই জমাট রক্ত ছুটে গিয়ে ফুসফুসের রক্তনালীতে আটকে যেতে পারে। এটাকে পালমোনারি এমবোলিজম (Pulmonary Embolism) বলে। এটা পরবর্তীতে ফুসফুসের অসুখ করতে পারে, এমনকি, বেশী বড় আকারের জমাট রক্ত হলে তাৎক্ষনিক মৃত্যুর কারণও হতে পারে।একটা কথা মনে রাখা জরুরী, যদি কোনো ব্যক্তির একবার থ্রম্বোসিস হয় বা বংশে থ্রম্বোসিস হওয়ার ইতিহাস থাকে, তাহলে তাঁর আবার থ্রম্বোসিস হওয়ার প্রবল সম্ভাবনা থাকে। করোনা অতিমারী (Corona Epidemic)-তে আমরা এতদিনে জানতে পেরেছি করোনায় আক্রান্ত হয়ে যারা মারাত্মকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েন তাঁদের মারাত্মক অসুখের কারণও রক্তনালীতে রক্ত জমাট বাঁধা বা থ্রম্বোসিস। এটা জানার পর উপযুক্ত চিকিৎসায় করোনায় মৃত্যুর হার এখন অনেক কমে গেছে।
প্রতিকার কি?
থ্রম্বোসিস প্রতিরোধ করার এখন অনেক উপায় আমাদের হাতে আছে। প্রথমেই থ্রম্বোসিসের যে কারণগুলো পরিহার করা যায় সেগুলো পরিহার করতে হবে। পুষ্টিকর খাবার, ডায়বেটিস ও উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। নিয়মিত হালকা ব্যায়াম করতে হবে। একটানা অনেক বসে থাকা যাবে না, বসে থেকেও পায়ের ব্যায়াম করা যায় যাতে পায়ের বড় শিরাতে রক্ত জমতে না পারে। ধূমপান-মদ্যপান ত্যাগ করতে হবে। থ্রম্বোসিস না হওয়ার জন্য চিকিৎসক কোনো ওষুধ দিলে নিয়মিত ওষুধ গ্রহণ করতে হবে। কোনো কোনো থ্রম্বোসিসে অপারেশনের প্রয়োজন হতে পারে। রক্ত রোগ (হেমাটোলজি বিশেষজ্ঞ) চিকিৎসকের পরামর্শ মেনে চলতে হবে। একবার থ্রম্বোসিস হয়ে গেলে আর যাতে না হয় সেজন্য নিয়মিত চিকিৎসকের ফলোআপে থাকতে হবে।